ঘরোয়া পদ্ধতিতে ভেষজ কীটনাশক প্রস্তুত ও এর ব্যবহার সমূহ

  বর্তমানে শহর কিংবা গ্রামে প্রায় সব বাড়িতেই কিছু না কিছু গাছ থাকে।  অনেকে আবার বারান্দা বা ছাদে জায়গা থাকলে শাক বা সবজিও চাষ করেন। এসব গাছে বাজার থেকে কেনা রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার না করে ঘরোয়া পদ্ধতিতে ভেষজ কীটনাশক করতে পারেন , উদ্ভিদজাত এবং অন্যান্য সামগ্রী নিয়ে ঘরোয়া পদ্ধতিতে প্রস্তত করা কয়েকটি ভেষজ ঔষধের প্রস্তত প্রণালী এবং ব্যবহার সম্বন্ধে চলুন আলোচনা করা যাক ।


পোস্ট সূচিপত্রঃ

তেলের কীটনাশক

যেকোন ভেজিটেবল অয়েলের সাথে মাইল্ড বা অল্প মাত্রার ক্ষার আছে এমন সাবান যোগ করে কীটনাশক বানানো যায়। ১ কাপ ভেজিটেবল অয়েল আর ১ টেবিল চামচ সাবান (লিকুইড সাবান) মিশিয়ে ভালো করে ঝাঁকিয়ে নিন।

এরপর ২ চা চামচ তেলের মিশ্রণ ৪ কাপ পানির সাথে মিশিয়ে ভালো করে ঝাঁকিয়ে নিয়ে স্প্রে বোতল ব্যবহার করে গাছে ছেটান। ছোট ছোট পোকা দূর করবে এই কীটনাশক। গাছের পাতা যে পোর বা ছোট ছোট ছিদ্রের সাহায্যে শ্বাস নেয়, সেগুলো বন্ধ করে রাখে কিছু ক্ষুদ্র আকারের পোকা। তেল ও সাবানের মিশ্রণে আটকা পড়ে অস্বস্তিতে ভুগে পাতা ছেড়ে পালাবে এসব পোকা। ঘরোয়া এই পদ্ধতি ব্যবহারে খরচ অনেকটাই কম হয় ।

সাবানের তৈরি কীটনাশক

সাবান দিয়ে সহজেই কীটনাশক বানানো যায়। নানা রকম মাইট, হোয়াইটফ্লাই, অ্যাফিড ও গুবরে পোকার মতো ছোট ছোট পোকা দমনে এই স্প্রে দারুণ কার্যকরী ।দেড় চা চামচ মাইল্ড বা অল্প মাত্রার ক্ষার আছে এমন লিকুইড সাবানের সাথে চার কাপ পানি মেশাতে হবে। গাছের আক্রান্ত অংশে সরাসরি স্প্রে করুন। মনে রাখা ভালো, তীব্র রোদের মধ্যে না ব্যবহার করে সন্ধ্যার পর বা ভোরে এই স্প্রে ব্যবহার করলে উপকার পাওয়া যাবে। কেননা সন্ধ্যা এবং ভোর বেলায় পোকাগুলো গাছে অবস্থান করে , এতে কীটনাশকের কার্যকারিতা ফল ভালো পাওয়া যায়।


নিমের তেল দিয়ে কীটনাশক

নিম গাছের বীজের তেল কীটনাশক হিসেবে দারুণ কার্যকরী। ডিম, লাভা ও বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়ার সব পর্যায়েই পোকামাকড় দমন করতে সক্ষম এই তেল। যেসব পোকা গাছের পাতা ও ডালপালা খেয়ে জীবন ধারণ করে তাদের মারতে ব্যবহার করুন এই তেল। পোষাপ্রাণী, মাছ বা অন্য কোন প্রাণীর কোনরকম ক্ষতি করে না এই তেল।

২ চা চামচ নিম তেলের সাথে ১ চা চমচ মাইল্ড লিকুইড সাবান ভালোভাবে ঝাঁকিয়ে মেশান। এরপর চার কাপ পানির সাথে মিশিয়ে গাছে স্প্রে করুন। এছাড়াও নিম গাছের প্রত্যেকটি অংশ শস্য সুরক্ষার জন্য ব্যবহার করা যায়। কীটনাশক, কীট বিকর্ষক, ছত্রাক(ভেকুর) নাশক এবং শস্য ক্রিমি নিয়ন্ত্রনের জন্য নিম প্রয়োগ করলে ভাল ফল পাওয়া যায়। নিম দিয়ে নিয়ন্ত্রন করা শস্য অনিষ্টকারী কীটগুলি হল মোয়া পোকা,শোহানী পোকা, পাতা খাওয়া পোকা, মাজরা পোকা, ফরিং, রাইছ ঊইভিল এবং অন্যান্য কোমল শরীরের পোকা ।


রসুন তেলের তৈরি কীটনাশক

রসুনের তীব্র গন্ধ গাছের পোকামাকড় দূর করতে সক্ষম। দুটো বড় রসুন অল্প পানি দিয়ে মিহি করে বেটে নিন বা ব্লেন্ডারে পেস্ট করুন। আবার এতে চার কাপ পানি দিয়ে সারারাত রেখে দিন।

সকালে নরম কাপড়ের ভালোভাবে চাপ দিয়ে ছেঁকে নিয়ে এতে আধা কাপ ভেজিটেবল অয়েল ( না দিলেও চলে), ১ চা চামচ মাইল্ড লিকুইড সাবান, আর অল্প পানি মিশিয়ে ঝাকিয়ে নিন। গাছে দেওয়ার সময় ১ কাপ রসুনের মিশ্রণ ৪ কাপ পানির সঙ্গে মিশিয়ে আক্রান্ত গাছে স্প্রে করুন। এটি একটি কার্যকারী ঘরোয়া পদ্ধতিতে তৈরি ভেষজ কীটনাশক।


মরিচ দিয়ে কীটনাশক তৈরি

মরিচ সাধারণত আমরা রান্নাবান্নার কাজে ব্যবহার করে থাকি, এটি যেমন খাবারের স্বাদ বাড়ায় তেমনি এর বিকল্প উপকারিতা রয়েছে । কাঁচা মরিচ বাটা বা শুকনো মরিচের গুঁড়ো ব্যবহার করে বানিয়ে নিতে পারেন মরিচ স্প্রে।
 ৪ কাপ পানির মধ্যে ১ টেবিল চামচ কাঁচা বা শুকনো মরিচের গুঁড়ো আর কয়েক ফোঁটা মাইল্ড লিকুইড সাবান দিয়ে ঝাঁকিয়ে মিশ্রণ বানান। তারপর সরাসরি আক্রান্ত গাছে স্প্রে করুন।
অথবা আধা কাপ কাঁচা বা শুকনো মরিচ ১ কাপ পানি দিয়ে মিহি করে বেঁটে বা ব্লেন্ড করে নিন। এরপর চার কাপ পানি দিয়ে জ্বাল দিন। কিছুক্ষণ ফুটিয়ে ঠান্ডা করে নরম কাপড়ে হাতের চাপ দিয়ে ভালোভাবে ছেঁকে নিন। এবার এতে কয়েক ফোঁটা মাইল্ড লিকুইড সাবান দিয়ে ভালোভাবে ঝাঁকিয়ে বানিয়ে ফেলুন ঘরোয়া পদ্ধতিতে ভেষজ কীটনাশক এবং প্রস্তুতকৃত মিশ্রণটি নিয়ে গাছে স্প্রে করুন।

মশলাদার পানির তৈরি কীটনাশক

আমাদের সবার রান্নাঘরে সহজেই মিলবে এমন মশলা দিয়েও বানানো যায় কীটনাশক। একটা গোটা রসুন, একটা  পেঁয়াজ আর ১ চা চামচ কেয়ান পিপার (যা আপনি সচরাচর সব মার্কেটেই পেয়ে যাবেন ) একসাথে বেঁটে বা ব্লেন্ড করে এক ঘন্টা রেখে দিন।

মিশ্রণটি এক ঘন্টা পরে নরম মসৃণ কাপড়ে হাতের চাপ দিয়ে ভালোভাবে তা ছেঁকে নিন । তার সঙ্গে ১ টেবিলচামচ মাইল্ড লিকুইড সোপ মিশিয়ে ভালো করে ঝাঁকিয়ে নিন। আক্রান্ত পাতার দুই পাশেই স্প্রে করুন এই কীটনাশক।এই পাতায় টোমাটাইন নামে একধরণের অ্যালকালয়েড থাকে যা অ্যাফিডসহ অন্যান্য কিছু ছোট পোকা দমন করে। ২ কাপ তাজা টমেটো পাতা কুচি করে ৪ কাপ পানিতে সারারাত ভিজিয়ে রাখুন। সকালে মিশ্রণটা ছেঁকে নিয়ে পানিটা সরাসরি গাছে স্প্রে করুন

রাসায়নিক কীটনাশক এর ক্ষতিকারক ব্যবহার

আমরা ফসল উৎপাদনে, উদ্ভিদ ও প্রাণীর চিকিৎসায় বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করে থাকি। এছাড়াও বালাই দমনের জন্য ষাটের দশকে সবুজ বিপ্লবের পর থেকে বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বর্তমান সময়ে কৃষি জমিতে আঁগাছা, রোগ ও পোকা দমনে জৈব বালাইনাশকের পরিবর্তে ব্যাপক হারে নিয়ম না মেনে রাসায়নিক কীটনাশক, ছত্রাকনাশক, ব্যাকটেরিসাইড, কৃমিনাশক (নেমাটিসাইড) ব্যবহৃত হচ্ছে। ফসল উৎপাদনে বা উদ্ভিদের বালাই দমনে ব্যবহৃত এসব রাসায়নিক কীটনাশকের মধ্যে কোনো কোনোটির দীর্ঘ মেয়াদি রেসিডিউয়াল ইফেক্ট রয়েছে যা মাটি, পানি ও জীব জগৎকে ব্যাপকহারে দূষিত করছে। এর ফলে জমির উর্বরতা বা ফসল উৎপাদন ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। মাটি, পানি ও বায়ু দূষিত হয়ে প্রাণিকূলে বিভিন্ন ধরনের রোগবালাইসহ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ সৃষ্টি করছে।
 

পশুপাখি ও উদ্ভিদ মূলত পরিবেশের খাদ্যশৃঙ্খল ও বাস্তুসংস্থান নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। যেমন: ফিঙ্গে, শালিক, দোয়েল পাখি ক্ষেতখামারে ফসলের ক্ষতিকর পোকা খায়; ব্যাঙ, সাপ, গুইসাপ ফসল ও পরিবেশের বিভিন্ন ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ খায়; টিকটিকি বসতবাড়িতে মশা মাছি খায়। সুতরাং এসব উপকারী প্রাণী, পাখিকে রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি।  রাসায়নিক ওষুধের পরিবর্তে জৈব বালাইনাশক বিশেষ করে কৃষি জমিতে, ফসলে, উদ্ভিদের চিকিৎসায় ব্যবহার করতে হবে। তাহলে মাটি, উদ্ভিদ ও প্রাণী উভয়ের জন্যই ভালো হবে। এতে পরিবেশ থাকবে নির্মল এবং স্বাস্থ্যসম্মত একটি পরিবেশ তৈরি হবে ।

পরিবেশ রক্ষার্থে আমাদের করণীয় 

রাসায়নিক বালাইনাশকের চেয়ে জৈব বালাইনাশক বিষাক্তহীন বা কম বিষাক্ত বালাইনাশক । এতে পরিবেশের এবং ব্যবহারকারীর কোন স্বাস্থ্যঝুঁকি নেই। এটা কেবল নির্দিষ্ট বালাইকে দমন করে, অন্য কোন ইকোসিস্টেমের ক্ষতি করে না। এ ধরনের বালাইনাশক প্রাকৃতিক পরিবেশে দ্রুত নিঃশেষিত হয় বলে এদের কোন ধরনের রেসিডিউয়াল ইফেক্ট নেই। কোন কোন ফসলে জৈব বালাইনাশক ব্যবহারে অধিক ফলন দেয়। এ ধরনের বালাইনাশক প্রয়োগকৃত ফসল খাওয়া নিরাপদ এবং ফসলের উৎপাদন খরচও অনেক কম।
তাই আমাদের সকলকে সচেতন হতে হবে যথাসম্ভব রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়ে জৈবিক কীটনাশক বা ভেষজ কীটনাশকের ব্যবহার করতে হবে যেন পরিবেশ এবং স্বাস্থ্য সবকিছুই ঠিক থাকে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url