১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর চলনবিল অঞ্চলের কিছু সচেতন সমাজকর্মীদের পরিশ্রমের ফলে গুরুদাসপুর থানার খুবজীপুর গ্রামে অস্থায়ীভাবে চলনবিল জাদুঘর (Chalanbil Museum) প্রতিষ্ঠিত হয়। চলনবিলের বিভিন্ন ঐতিহাসিক নিদর্শন নিয়ে তৈরী এ জাদুঘরটি ১৯৮৯ সালের ২ জুলাই প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতাভুক্ত হয়। চলনবিল জাদুঘরে উল্লেখযোগ্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মধ্যে আছে বিষ্ণু ও মাতৃকা মূর্তিসহ নানা গবেষণা গ্রন্থ, কষ্টি পাথরের সূর্যদেব, ডাক টিকিট, ৯০টি দেশের মুদ্রা, ঘট, শিলা এবং বিভিন্ন শাসন আমলের টেরাকোটা।
এছাড়া এখানে আরো আছে বাদশা আলমগীর ও সম্রাট নাসিরুদ্দিনের নিজ হাতে লেখা দুটি কোরান শরীফ, তুলট কাগজের উপর হাতে লেখা প্রায় ৪০০ বছরের পুরনো ৮টি সম্পূর্ণ ও ৭টি আংশিক কোরান শরীফ, ১৫টি হাদিস শরীফ এবং ২৫৭টি বিভিন্ন ধর্ম গ্রন্থ।
চলন বিল
বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ বিলের নাম চলন বিল । নাটোর, সিরাজগঞ্জ এবং পাবনা জেলাজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ছোট ছোট অনেকগুলো বিলের সমষ্টি এই চলন বিল। বর্ষায় দ্বীপের মত ভাসমান সবুজ গ্রাম, শীতে অতিথি পাখির কলরব, সুনীল আকাশ এবং শরতে বিলের পাড় ধরে ফোটে থাকা কাশবনের সৌন্দর্য আগত দর্শনার্থীদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে। শুধুমাত্র ভরা বর্ষায় চলন বিলের প্রকৃত রূপ ধরা পড়ে। আর তখন প্রায় ৩৬৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জলে একাকার হয়ে যায়। বর্ষাকাল ছাড়াও প্রায় সারাবছরই চলন বিলের বুকে নৌকায় ভেসে বেড়াতে কিংবা বিলের বৈচিত্রপূর্ণ সৌন্দর্য উপভোগ করতে অসংখ্য পর্যটক ছুটে আসেন।
একসময় চলন বিলের মোট আয়তন ছিল ৫০০ বর্গমাইল বা প্রায় ১৪২৪ বর্গকিলোমিটার। তবে বর্তমানে চলন বিলের আয়তন কমে ১১৫০ বর্গ কিলেমিটারে পরিণত হয়েছে। চলন বিলের সাথে ছোট ছোট অসংখ্য বিল খালের মাধ্যমে এসে যুক্ত হয়েছে। পিপরূল, লারোর, ডাঙাপাড়া, তাজপুর, নিয়ালা, মাঝগাঁও, চোনমোহন, শাতাইল, দারিকুশি, গজনা, বড়বিল, সোনাপাতিলা এবং ঘুঘুদহ তেমনি কিছু বিলের নাম।
চলন বিলের বুকে মিশে গেছে করতোয়া, আত্রাই, গুড়, বড়াল, মরা বড়াল, তুলসী, ভাদাই সহ বেশ কয়েকটি নদী। মাছে সমৃদ্ধ চলন বিলে আছে চিতল, মাগুর, কৈ, শিং, বোয়াল, টাকি, শোল, মৃগেল, চিংড়ি, টেংরা, কালিবাউশ, রিটা, মৌসি, গজার, বৌ, সরপুটি, পুঁটি, গুজা, গাগর, বাঘাইর কাঁটা, তিতপুটি সহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ।
হালতির বিল
নাটোর সদর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে নলডাঙ্গা থানার অন্তর্গত হালতির বিল ।জেলার একটি অন্যতম বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে সুপরিচিত। নাটোর সদর উপজেলার পিপরুল, খাজুরা, মাধনগর ও ব্রহ্মপুর ইউনিয়ন জুড়ে হালতি বিলের বিস্তৃতি। আত্রাই নদীর সাথে যুক্ত থাকায় এই বিল প্রাকৃতিকভাবে বিভিন্ন প্রজাতির সুস্বাদু মাছের প্রজননস্থল হিসেবে বিখ্যাত। ঋতুতে ঋতুতে হালতির বিলের ভিন্ন ভিন্ন রূপের দেখা মিলে। বিশেষ করে বৈশাখ থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত বিলে আশেপাশের এলাকা ৫ ফুট থেকে ৮ ফুট পানিতে নিমজ্জিত থাকে। তখন বিলের মাঝে অবস্থিত ছোট ছোট গ্রামগুলো দেখতে দ্বীপের মতো মনে হয়। হালতি বিলের মধ্যে দিয়ে পিপরুলের সাথে খাজুরার সংযোগকারী প্রায় ৮ কিলোমিটার লম্বা সাবমারসিবল রাস্তাটি বিলের আরও সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলেছে।
হালতির বিল যাওয়ার পথে পাটুল থেকে খাজুরা পর্যন্ত রাস্তার সৌন্দর্য, উত্তাল ঢেউয়ে প্রবাহমান জলরাশি আর উদ্দাম বাতাস দর্শনার্থীদের মনকে সতেজ করে তোলে। উত্তরাঞ্চলের অনেকে তাই এই বিলকে মিনি সমুদ্র সৈকত হিসেবে আখ্যায়িত করেন। প্রতিবছর বর্ষাকালে এখানে নৌ-ভ্রমণ ও নয়ানভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগের জন্য প্রচুর পর্যটকের আগমন ঘটে।
গ্রীন ভ্যালী পার্ক
নাটোর জেলার লালপুর উপজেলা সদর থেকে মাত্র ২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত গ্রীন ভ্যালী পার্ক একটি চমৎকার বিনোদন কেন্দ্র। প্রায় ১২৩ বিঘা জায়গার উপর নির্মিত গ্রীন ভ্যালী পার্কটিতে সকল বয়সী দর্শনার্থীদের চিত্তবিনোদনের জন্য বিভিন্ন আকর্ষণীয় রাইডের মধ্যে আছে মিনি ট্রেন, বুলেট ট্রেন, নাগরদোলা, ম্যারিগো রাউন্ড, পাইরেট শীপ, হানি সুইং, স্পীডবোট, প্যাডেল বোট প্রভৃতি। এছাড়াও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মণ্ডিত মনোরম পরিবেশের এই পার্কের প্রায় ৩০ একর জায়গাজুড়ে একটি নয়নাভিরাম লেক রয়েছে।
তাছাড়াও রয়েছে পিকনিক স্পট, সুইমিং পুল, সহ নানান রকম জায়গা। যা দর্শনার্থীদের সকলের মন কেড়ে নেয় এক নিমিষেই এবং এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মনোরম পরিবেশ সমৃদ্ধ।
নাটোরের বিখ্যাত দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি বর্তমানে উত্তরা গণভবন নামে পরিচিত। নাটোরের রানী ভবানী তাঁর নায়েব দয়ারাম রায়কে দিঘাপতিয়া পরগনা উপহার দেন। পরবর্তীতে নায়েব সেখানে কয়েকটি প্রাসাদ গড়ে তোলেন। প্রায় ৪৩ একর আয়তনের লেক ও প্রাচীর বেষ্টিত রাজবাড়িটিতে মোট ১২ টি ভবন রয়েছে। উত্তরা গণভবনের পিরামিড আকৃতির চারতলা প্রবেশদ্বারের চূড়ায় বিখ্যাত কোক অ্যান্ড টেলভি কোম্পানির তৈরি একটি ঘণ্টা ঘড়ি স্থাপন করা হয়েছে। আর মূল প্রাসাদ ভবনে প্রবেশ করলে রাজার সিংহাসন, আক্রমণ ঠেকানোর বর্ম এবং তলোয়ার দেখতে পাওয়া যায়। রাজ প্রাসাদের প্রাঙ্গণে ইতালি থেকে সংগৃহীত ভাস্কর্যে সুসজ্জিত বাগান রয়েছে। মনোমুগ্ধকর এই বাগানে স্থান পেয়েছে হাপরমালি, নীলমণিলতা, রাজ-অশোক, পারিজাত, কর্পূর, সৌরভী, হৈমন্তী, যষ্টিমধু, বনপুলক, পেয়ালি, সেঁউতি, তারাঝরা, সাইকাস, মাধবী ইত্যাদি বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। এছাড়া আছে রাজা প্রসন্ননাথের অবক্ষমূর্তি, জমিদার দয়ারামের ভাস্কর্য, চারটি কামান, কুমার ভবন, তহশিল অফিস ও অতিথিশালা।
নাটোর জেলা শহর থেকে মাত্র ৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত উত্তরা গণভবনটি বর্তমানে উত্তরবঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর স্থানীয় কার্যালয় এবং বাসভবন হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তাই উত্তরা গণভবন পরিদর্শন করতে জেলা প্রশাসনের অনুমতি নিতে হয়।
বুধপাড়া কালীমন্দির
নাটোর জেলার লালপুর উপজেলার বুধপাড়ায় প্রায় ৫৩০ বছরের পুরনো বুধপাড়া কালীমন্দির অবস্থিত। মন্দির স্থাপনের সময়কালে এই উপমহাদেশে নবাবী আমল চলছিল। আর নবাব আলিবর্দি খানের আমলে বর্গীয় হাঙ্গামা শুরু হয়। বর্গীদের অন্যায় অত্যাচার থেকে বাঁচতে ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরের খাগড়া থেকে ৬০ ঘর কংস বণিক নাটোরের বুধপাড়ায় এসে বসতি স্থাপন করে। সেসময় তারা কালীপূজায় অর্চনার জন্য খড়ের ঘরের একটি মন্দির তৈরি করেন। যা বর্তমানে বুধপাড়া কালীমন্দির হিসেবে পরিচিত। ফলে সমগ্র দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে এই মন্দিরের রয়েছে ঐতিহাসিক গুরুত্ব।
বাংলা ১৩৩২ সনে খড়ের তৈরি মন্দিরটিকে পাকা দালানে রুপান্তরিত করা হয়। ততীতে মন্দিরের নামে ১৫০ বিঘার অধিক জমি থাকলে বর্তমানে কেবল কালী মন্দির ও গোবিন্দ মন্দির চত্বর মিলিয়ে সর্বমোট ৮ বিঘা জমির অস্তিত্ব আছে। বিভিন্ন পূজা পার্বণ ছাড়াও সারাবছর দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা বুধপাড়া কালীমন্দির দর্শনে আসেন। প্রতি বছর কার্তিক মাসে এই মন্দিরে মহাধুমধামে কালী পূজা অনুষ্ঠিত হয়। আর পূজা উপলক্ষে আয়োজিত মেলায় থাকে সকল শ্রেণী পেশা ধর্ম নির্বিশেষে বিভিন্ন বয়সের দর্শনার্থীদের আনাগোনা।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url