রাজশাহী অঞ্চলের বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ (দ্বিতীয় পর্ব)
বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলের শিক্ষা– শিল্প– সাহিত্য– সংস্কৃতি, সমাজসেবা– রাজনীতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে অসংখ্য প্রতিভাবান ও নিবেদিতপ্রাণ মানুষ স্ব স্ব অবদানের জন্য স্মরণীয় হয়ে আছেন৷ প্রিয় পাঠক, নিবেদিতপ্রাণ এসব বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ সম্পর্কে আলোকপাত করতেই আমাদের এ আয়োজন, আজ থাকছে দ্বিতীয় পর্ব।
পোস্ট সূচিপত্রঃ
- অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়
- মহারাণী হেমন্ত কুমারী দেবী
- এন্ড্রু কিশোর
- খোদা বক্স মৃধা
- হাসান আজিজুল হক
- খালেদ মাসুদ পাইলট
অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়
অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় একজন বাঙালি ইতিহাসবেত্তা এবং আইনজীবী ছিলেন। তিনি ১ মার্চ, ১৮৬১ সালে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত (বর্তমান রাজশাহী জেলা, বাংলাদেশ) জেলায় জন্মগ্রহণ করেন এবং ১০ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩০ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি বাংলা ভাষায় লেখা ইতিহাস, সাহিত্য, ভাষা, সংস্কৃতি, চিত্রকলা, প্রত্নতত্ত্ব ইত্যাদি নানা বিষয়ে অবদান রেখেছেন।
অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়ের কাহিনী গ্রন্থে তাঁর বিখ্যাত রচনাবলি অন্তর্ভুক্ত আছে, যা বিভিন্ন বই এবং মাসিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। সমরসিংহ (১৮৮৩)
সিরাজদ্দৌলা (১৮৯৮) মীরকাসিম (১৯০৬)গৌড়লেখমালা (১৯১২)ফিরিঙ্গি বণিক (১৯২২)সীতারাম রায় (১৮৯৮)অজ্ঞেয়বাদ (১৯২৮অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়কে “কায়সার–ই–হিন্দ” স্বর্ণপদক (১৯১৫) ও সি আই ই উপাধি (১৯২০) পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়েছে
মহারাণী হেমন্ত কুমারী দেবী
মহারাণী হেমন্ত কুমারী দেবী একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তি ছিলেন যিনি মানিকগঞ্জ জেলায় প্রসিদ্ধ হন। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৮৬৯ সালে মানিকগঞ্জ জেলা, ঢাকা, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারতে এবং ১১ জুলাই, ১৯৪২ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি পুঠিয়ার জমিদার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। মহারাণী হেমন্ত কুমারী দেবীর দাম্পত্য সঙ্গী ছিলেন যতীন্দ্র নারায়ণ। মহারাণী হেমন্ত কুমারীর জমিদারী হিসেবে তিনি বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রম পরিচালনা করেছিলেন যা, সমাজকল্যাণ মূলক ছিল। রাজশাহী শহরে তিনি একটি ছাত্রাবাস চালিয়েছিলেন যা বর্তমানে রাজশাহী কলেজের অধীনে মহারাণী হেমন্ত কুমারী হিন্দু ছাত্রাবাস নামে পরিচালিত হয়। তিনি পানির সরবরাহের কাজে হেমন্ত কুমারী ওয়াটার ওয়ার্কস, সংস্কৃত শিক্ষা উন্নতির জন্য হেমন্ত কুমারী সংস্কৃত কলেজ, নওগাঁ দাতব্য চিকিত্সালয়ে বার্ষিক দান, ভাগিরথিতে স্নানঘাট নির্মাণের সহায়তা, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন স্মৃতি তহবিলে দান, নান্দিনায় (ময়মনসিংহ) ডাকঘর গৃহ নির্মাণ, পূরীধামের অনাথ আশ্রম এবং হেমন্ত নাথের মন্দিরে দান প্রদান করেছিলেন। তাঁর এই সমাজকল্যাণ কার্যক্রমগুলি উল্লেখযোগ্য ছিল।
আরো পড়ুনঃ নাটোর জেলার বিখ্যাত ব্যক্তি
এন্ড্রু কিশোর
এন্ড্রু কিশোর কুমার বাড়ৈ ছিলেন বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত লোকসঙ্গীত শিল্পী। তিনি ৪ নভেম্বর ১৯৫৫ সালে রাজশাহীতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৬ জুলাই, ২০২০ সালে ৬৪ বছর বয়সে মৃত্যু বরণ করেন। এন্ড্রু কিশোর প্রধানত লোকসঙ্গীত, পপ এবং চলচ্চিত্রের গানে পরিচিত ছিলেন। তিনি ১৯৭৭ থেকে ২০২০ পর্যন্ত অধিকাংশ সময় নেপথ্য সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে কাজ করেন। এন্ড্রু কিশোর বাংলাদেশে একটি অপার গানের শিল্পী হিসেবে বিখ্যাত হন এবং তাঁর বেশ কয়েকটি গান অনেকবার জনপ্রিয়তার উচ্চতা ছুঁয়েছে।এন্ড্রু কিশোরের চলচ্চিত্রে নেপথ্য সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে যাত্রা শুরু হয় ১৯৭৭ সালে আলম খান সুরারোপিত মেইল ট্রেন চলচ্চিত্রের “অচিনপুরের রাজকুমারীনেই যে তার কেউ” গানের মধ্য দিয়ে। ১৯৮৭ সালে তিনি সারেন্ডার চলচ্চিত্রে আলম কানের সুরে তিনটি গানে কণ্ঠ দেন, সেগুলো হল “সবাইতো ভালোবাসা চায়”, “গুন ভাগ করে করে”, ও “ঘড়ি চলে ঠিক ঠিক”। তন্মধ্যে প্রথমোক্ত গানটি জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং এই গানের জন্য তিনি তার দ্বিতীয় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। এছাড়া তিনি ক্ষতিপূরণ (১৯৮৯), পদ্মা মেঘনা যমুনা (১৯৯১), কবুল (১৯৯৬), আজ গায়ে হলুদ (২০০০), সাজঘর (২০০৭) ও কি যাদু করিলা (২০০৮) চলচ্চিত্রের গানের জন্য আরও আটবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।
খোদা বক্স মৃধা
খোদা বক্স মৃধা বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত ক্রীড়া ধারাভাষ্যকার এবং কলেজ শিক্ষক ছিলেন। তিনি ২২ জানুয়ারি, ১৯৪৫ সালে হেতেমখাঁ, রাজশাহী জেলায় জন্মগ্রহণ করেন এবং ৩০ মার্চ, ২০১০ সালে ৬৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি এমএ (রাষ্ট্রবিজ্ঞান) ডিগ্রি অর্জন করেন এবং ১৯৬৮ সালে সিলেট এমসি কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে অধ্যাপনা দিয়ে শিক্ষকতা পেশার শুরু করেন। এরপর তিনি বিভিন্ন সময় রাজশাহী সরকারি সিটি কলেজ, নিউ গভর্নমেন্ট ডিগ্রি কলেজ, রাজশাহী কলেজ এবং রাজশাহী সরকারি মহিলা কলেজে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৪ সালের মে মাসে তিনি শরীয়তপুরের নড়িয়া সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। ২০০৩ সালে রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে শিক্ষকতা পেশা থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
আরো পড়ুনঃ বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সংক্ষিপ্ত জীবনী
খোদা বক্স খেলোয়াড় হিসেবে রাজশাহী জেলা ক্রিকেট দলের অধিনায়কত্ব করেছেন। রাজশাহীতে ১৯৬০ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন সানরাইজ স্পোর্টিং ক্লাব নামের একটি ক্রীড়া সংগঠন। ১৯৭২ সালে এক অডিশনের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশ বেতারে ধারাভাষ্যকার হিসেবে সুযোগ পান। ছয় বছর পর তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনে ধারাভাষ্যকার হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। এরপর থেকে মৃত্যুর পূর্বে প্রায় ৩৮ বছর ধারাভাষ্যকার হিসেবে কাজ করেছেন তিনি।
হাসান আজিজুল হক
হাসান আজিজুল হক বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত অধ্যাপক এবং কথাসাহিত্যিক ছিলেন। তিনি ২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৯ সালে বার্ধমান জেলায় জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৫ নভেম্বর, ২০২১ সালে রাজশাহীতে ৮২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। আজিজুল হক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন এবং শিক্ষানবিশ কর্মসূচিতে ব্যস্ত ছিলেন। তিনি প্রধানত কথাসাহিত্য ও গবেষণামূলক লিখালিখি করেন। ‘আগুনপাখি‘ ও ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাবলী।
রাজশাহী কলেজে পড়ার সময় কলেজের উদ্যমী তরুণ মিসবাহুল আজীমের সম্পাদনায় প্রকাশিত ভাঁজপত্র ‘চারপাতা‘য় হাসানের প্রথম লেখা ছাপা হয়, লেখাটির বিষয় ছিল রাজশাহীর আমের মাহাত্ম্য। প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য‘ এর প্রথম গল্প ‘শকুন‘ এ সুদখোর মহাজন তথা গ্রামের সমাজের তলদেশ উন্মোচিত করেছিলেন তিনি। প্রায় অর্ধশতাব্দীর গল্পচর্চায় বিষয়, চরিত্র ও নির্মাণকুশলতায় হাসান আজিজুল হক অনেক উল্লেখযোগ্য গল্পের রচয়িতা। এসবের মধ্যে রয়েছে ‘শকুন‘, ‘তৃষ্ণা‘, ‘উত্তরবসন্তে‘, ‘বিমর্ষ রাত্রি, প্রথম প্রহর‘, ‘পরবাসী‘, ‘আমৃত্যু‘ ‘আজীবন‘, ‘জীবন ঘষে আগুন‘, ‘খাঁচা‘, ‘ভূষণের একদিন‘, ‘ফেরা‘, ‘মন তার শঙ্খিনী‘, ‘মাটির তলার মাটি‘, ‘শোণিত সেতু‘, ‘ঘরগেরস্থি‘, ‘সরল হিংসা‘, ‘খনন‘, ‘সমুখে শান্তির পারাবার‘, ‘অচিন পাখি‘, ‘মা–মেয়ের সংসার‘, ‘বিধবাদের কথা‘ ‘সারা দুপুর‘ ও ‘কেউ আসেনি‘।
আরো পড়ুন ঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সংক্ষিপ্ত জীবনী
তিনি একাডেমিক কাজের পাশাপাশি সাহিত্যিক কর্মসূচিতেও সক্রিয় ছিলেন। আজিজুল হককে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক ও স্বাধীনতা পুরস্কার সহ অনেকগুলি পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়েছে। তিনি শামসুন নাহার বেগমের সাথে দাম্পত্যজীবন অতিবাহিত করেন।
খালেদ মাসুদ পাইলট
খালেদ মাসুদ পাইলট হলেন একজন বাংলাদেশি ক্রিকেটার। তিনি ডান হাতে ব্যাট করতেন এবং উইকেট–রক্ষক ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি বাংলাদেশ জাতীয় দলের সদস্য হিসেবে অংশগ্রহণ করেছেন এবং রাজশাহী বিভাগ দলের প্রতিনিধিত্ব করেছেন।
খালেদ মাসুদ পাইলটের ক্রিকেট ক্যারিয়ারে তিনি ১০ নভেম্বর ২০০০ সালে ভারতের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক করেন। তিনি মোট ৬০টি টেস্ট ম্যাচে অংশগ্রহণ করেন এবং শেষ টেস্ট খেলেন ২৮ জুন ২০০৭ সালে শ্রীলঙ্কা বিপক্ষে। খালেদ মাসুদ পাইলট প্রথম ওডিআই শুরু ৫ এপ্রিল ১৯৯৫ সালে ভারতের বিপক্ষে। তিনি শেষ ওডিআই খেলেন ৫ই ডিসেম্বর ২০০৬ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। তিনি বাংলাদেশের হয়ে নভেম্বর ২০০১ থেকে জুন ২০০৩ পর্যন্ত অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফির ফাইনালে এই মারমুখী ব্যাটসমানের ব্যাট থেকে আসা ছয় রান কেনিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ জয়ে বিশেষ অবদান রাখে। টেস্ট এবং একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ উভয় অঙ্গণে তিনি রেখেছেন তার সফলতার স্বাক্ষর।
আরো পড়ুনঃ বেগম রোকেয়ার জীবনী
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url